কদিন আগে, আমরা এক প্রতিবেশীর সাথে একটা রেস্তরায় দেখা করতে গেলাম। উনাদের আপ্যায়নে আমরা রীতিমত মুগ্ধ, তবে একটি বিষয় নিয়ে তারা অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত মনে হল। একটু পরেই তা হাতেনাতে দেখতে পেলাম। উনাদের বাচ্চার বয়স ৮-১০ বছর হবে, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। ওর বাবা যখন আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বললেন, দেখো বাবা কে এসেছে? হ্যালো বল- বাচ্চাটি তার মোবাইল ফোন থেকে এক সেকেন্ড এর জন্য মুখটা তুলে যেভাবে ধমকের সুরে আমাদের হ্যালো বলল, তাতে করে আমার মনে হল যে থাক বাপ, এই হ্যালোর চেয়ে নো হ্যালো অনেক বেটার। আমি নোটিশ করছিলাম, পুরো ২ ঘণ্টা জুড়ে বাচ্চাটি একবারও চোখ তুলে তাকায়নি, দেখেনি সে কোথায় এসেছে, আশেপাশে যে আরও বাচ্চারা খেলা করছে। এর ভীতর একবার তার মা তার হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাচ্চাটি এমন চিৎকার জুড়ে দিলো যে তিনি বিব্রত হয়ে আবার ফোনটি তার হাতে তুলে দিলেন। ভাইটি আফসোস করে বললেন, কি যে করি ভাই, কোন ভাবেই কিছু হচ্ছেনা, বাচ্চাটি মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে গেছে। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, এই অবস্থায় নিশ্চয় একদিনে আসেনি, খুলে বলুনতোঁ, কি করে এমনটা হল? আজ বলবো আমাদের আসেপাশে ছড়িয়ে থাকা সেই গল্প গুলোয়। আশা করছি পুরো গল্পটি শুনবেন, আর সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে তা সব বাচ্চার বাবা মা এর সাথে শেয়ার করবেন।
বিভিন্ন রিসার্চে দেখা গেছে যে- প্রতি ৩ শিশুর ভীতর ২টি শিশু প্রতিদিন অন্তত ৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোনে ডুবে থাকে। যখন তারা স্মেলস লাইক টিন স্পিরিট … মানে টিন এইজে পা রাখে তখন তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতিদিন ৯ ঘণ্টার বেশি। তাদের ভীতর ৬৬% বাচ্চারা আবার সাথে ফোন না থাকলে নাকি তারা অস্থিরতা অনুভব করেন। এংজাইটি আর ডিপ্রেশন অনুভব করেন।
টিন এজারস …
পুরো পৃথিবীর প্রায় ৭৭% শিশু এসব ডিভাইসে এক্সপসড। ৪৫% শিশু সর্বদায় অনলাইনে কানেক্টটেড থাকে। এটি একটি স্লো পইসনিং, আসতে আসতে, অল্প অল্প করে ঠেলে দিচ্ছে এমন এক গহ্বরে যেখান থেকে ফেরত আসা অনেকটা ডন কে পাকড়াও করার মতন...
সেলফোন যে আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে, অতিরিক্ত সেলফোন ব্যবহার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের উপর। আসুন কিছু নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমত, শারীরিক কার্যকলাপ হ্রাস। গেমস, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন ভিডিও দেখা, যা শুরু হয় বেবি সার্ক দিয়েই। এভাবেই অভ্যাস শুরু হয় আর পরবর্তীতে বাচ্চারা তাদের পর্দার সাথে আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। এতে করে তাদের শারীরিক কার্যকলাপ কমে যায়, পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ হল মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে ক্রমাগত এক্সপোজার উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং কম আত্মসম্মানবোধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অন্যদের সাথে ক্রমাগত তুলনা, সাইবার বুলিং, এবং অনলাইনে বৈধতা পাওয়ার চাপ একটি শিশুর মানসিক সুস্থতার উপর মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে। অনেকটা রাজকুমারি Rapunzel এর প্রথম বারের মতন ঘাসের দেখা পাওয়ার মতন, পৃথিবী কতো সুন্দর তা তারা বুঝতে পারেনা।
ঘুমের ব্যাঘাত আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা প্রায়ই দেখা যায়। সেলফোন দ্বারা নির্গত নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদনে হস্তক্ষেপ করতে পারে, হরমোন যা ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের ঘুমিয়ে পড়া কঠিন করে তোলে, যার ফলে অপর্যাপ্ত বিশ্রাম হয় এবং তাদের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা এবং বুদ্ধি বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এতেনশান স্প্যান এত কমে যায় যে তারা এক জিনিষে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
এখন যেহেতু আমরা নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি বুঝতে পেরেছি, আসুন শিশুদের মধ্যে সেলফোন আসক্তি রোধ করার কিছু উপায় অন্বেষণ করি। এই বিষয়ে আমরা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সিফাত ই সাইদ এর সাথে যোগাযোগ করি আর উনার দেওয়া কিছু পরামর্শ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি-
১. শিশুকে স্ক্রিণ দিবেন কিন্তু ইন্টারনেট অফ রাখবেন। এই অংশটি অত্যন্ত জরুরি। ইন্টারনেট অন থাকলে শিশু ক্রমাগত স্ক্রল করে এক ভিডিও থেকে অন্য ভিডিও তে চলে যায়, এবং প্রায় ই এমন কিছু কনটেন্ট দেখে ফেলে যা একেবারেই তার বয়স উপযোগী নয়। ক্রমাগত স্ক্রল করার কারণে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও তার কমতে থাকে। তাই শিশু একেবারে ছোট থাকতেই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ইন্টারনেট অন করার সময় wifi/mobile data এর আইকন গুলি শিশুরর সামনে টিপবেন না। একবার যদি সে দেখে ফেলে কোন বাটন চাপলে ইন্টারনেট অন হয়, তখন সে নিজেই wifi অন করে দেখা শুরু করবে। শিশুদের বোকা ভাববেন না।
২. বাবা-মায়েরা বলেন যে ইন্টারনেট না থাকলে শিশু মোবাইল/ ট্যাব এ কি দেখবে? আপনি তার বয়স এবং আমাদের সংষ্কৃতির সাথে এর সাথে উপযোগী কিছু কনটেন্ট/ভিডিও ডাউনলোড করে দেবেন, সেই ভিডিও গুলোই সে দেখবে। এক মাস পর পর আগের ভিডিও ডিলিট করে নতুন ভিডিও ডাউনলোড করুন নতুবা সে বোরড হয়ে যাবে।
৩. শুধুমাত্র ইউ টিউব না দেখিয়ে তাকে খেলার ছলে শেখায় এরকম কিছু app ব্যবহার করতে দিন। যেমন: Khan academy kids, ABC kids, Piano Kids. এতে তার ভিডিওর প্রতি আসক্তি তৈরি হবেনা
৪. আপনার মোবাইলের পাসওয়ার্ড/ প্যাটার্ণ লক যেন শিশু না জানে সেই বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকুন, শিশুর সামনে মোবাইলে পাসওয়ার্ড/প্যাটার্ণ দেবেন না। কোনভাবে শিশু যদি জেনে ফেলে, পাসওয়ার্ড/ প্যাটার্ণ লক পরিবর্তন করুন।
৫. শিশু যখণ স্ক্রিন দেখবে, তখন ও তার সাথে Interact করুন। যেন সে একদৃষ্টে নিবিড় মনোযোগের সাথে স্ক্রিন না দেখতে পারে। এটাকে বলা হয় Processed Screen Time. যেমন: সে ‘ম্যারি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ এর ভিডিও দেখছে, আপনি তাকে বলুন, বাহ কি সুন্দর একটা ভেড়া, ওর নাম কি? ওর গায়ের রঙ কি?
৬. শিশু স্ক্রিণ দেখার সময় তার আশে পাশে থাকার চেষ্টা করুন। আপনি এক রুমে কাজ করছেন, শিশু আরেক রুমে বসে নিবিষ্টভাবে স্ক্রিন দেখছে, এটা যেন না হয়। একেবারেই অপারগ হলে তাকে এই সময় টিভি দেখতে দিন, মোবাইল/ট্যাব নয়।
৭. শিশুকে তার নিজস্ব ডিভাইস দেবেন না। অর্থাৎ একটি মোবাইল/ট্যাব/ আই প্যাড যেটা একান্তই তার নিজের, আর কেউ সেটা ব্যবহার করেনা, এমনটা যেন না হয়। কোথাও বেড়াতে গেলে সর্বক্ষণ তাকে ডিভাইস দিয়ে রাখবেন না। তাকে প্রকৃতির সাথে মিশতে দিন, অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিন। ডিভাইস হাতে থাকলে সে আর কোনদিকেই মনোযোগ দেবেনা।
প্রযুক্তি-মুক্ত অঞ্চল বা পিরিয়ড তৈরি করুন। নির্দিষ্ট এলাকা বা সময় নির্দিষ্ট করুন যেখানে সেলফোন বন্ধ থাকে, যেমন খাবারের সময়, পরিবারের বাইরে বের হওয়ার সময় বা ঘুমানোর আগে। এটি মুখোমুখি যোগাযোগকে উত্সাহিত করে।
৮. শিশু কতক্ষণ টিভি/মোবাইল/ ট্যাব দেখবে সেটা দেখার আগেই সময় বেঁধে দিন এবং সেটা strictly মেনে চলুন। আপনি যদি তাকে বলেন, তোমাকে আধা ঘন্টার জন্য মোবাইল/ টিভি দেখতে দিলাম, তাহলে ঠিক আধা ঘন্টা পরেই এটা ফেরত নিন। ফেরত নেবার সময় শিশু দিতে চাইবেনা, কান্নাকাটি করবে, আরো একটু সময় চাইবে, তাতে গলে যাবেন না।
একটি পারিবারিক চুক্তি তৈরি করুন যা কখন এবং কতক্ষণ সেলফোন ব্যবহার করা যেতে পারে তার রূপরেখা দেয়। আপনার সন্তানকে অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত করতে উত্সাহিত করুন যেমন পড়া, বাইরে খেলা বা শখগুলি অনুসরণ করা যা শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার প্রচার করে।
৯. অনেক শিশু আছে স্ক্রিন না দেখলে কিছুতেই খায় না। তাঁদের কে নিজের হাতে মাঝে মাঝে খাবার খেতে দিন, খাবার হয়ত অল্প খাবে কিন্তু তার সু-অভ্যাস গড়ে উঠবে। এক বেলা স্ক্রিন সহ খাওয়ালে অন্য বেলায় স্ক্রিন ছাড়া খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
১০ অত্যধিক সেলফোন ব্যবহারের সাথে যুক্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষিত করুন। তাদের আসক্তির লক্ষণ এবং প্রযুক্তির সাথে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব সনাক্ত করতে শেখান। খোলামেলা কথোপকথনকে উত্সাহিত করুন এবং দায়িত্বশীল অনলাইন আচরণ সম্পর্কে কথা বলুন।
১১. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট টি সবার শেষে বলছি। বাবা-মায়ের নিজেদের ডিভাইস আসক্তি কমাতে হবে। একটি শিশু যদি তার বাবা-মাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখে, তাহলে সে নিজেও তাই করবে। আপনি শিশুকে যা শেখাতে চান, আপনি নিজে আগে তা করুন। বাস্তব-বিশ্বের ইন্টারঅ্যাকশনের সাথে স্ক্রিন টাইমের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং পরিবার হিসেবে একসঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানোর গুরুত্ব তাদের দেখান।
** উল্লখ্য যে ওপরের সবগুলি পয়েন্ট স্বাভাবিক বিকাশের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য। যেসব শিশুরা কথা দেরিতে বলছে (স্পিচ ডিলে), চোখে চোখে তাকায় না, অন্য শিশুদের সাথে interact করেনা, ডাকলে ঠিকভাবে সাড়া দেয় না, তাদের জন্য স্ক্রিণ টাইম শূণ্য তে নিয়ে আসতে হবে।
মনে রাখবেনঃ ডিভাইস/স্ক্রিণ human interaction এর বিকল্প নয়। শিশুকে প্রচুর সময় দিবেন, তার সাথে খেলবেন, কথা বলবেন, ছড়া শোনাবেন, গান শোনাবেন। তাকে ধর্ম শিক্ষা দিন, আমাদের সংষ্কৃতির সাথে পরিচিত করান, তাকে বাসার বাইরে মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে নিয়ে যান।
ডিভাইস আমাদের অতি ব্যস্ত জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, কিন্তু শিশুর ক্ষেত্রে যতটা কম সম্ভব স্ক্রিণ ব্যবহার করবেন, ততই মংগল। পরিবারের সদস্যদের সাথে গুণগত সময় কাটানোর কোন বিকল্প নেই।
মনে রাখবেন, শিশুদের জন্য সেলফোন ব্যবহারের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, আমরা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি এবং তাদের প্রযুক্তিকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করার জন্য Empower করতে পারি।
আজ আমি একটু ভয়ের ভীতর আছি, এই মনে হয় শিশুর বাবা মা এরা আমার উপরে হামলা করে বসবেন, ব্যাক্তিগত প্রশ্ন বান ছুড়া শুরু করবেন, আপনার কয়টা বাচ্চা আসে? আপনি আগে বাপ হন, তারপরে লেকচার দিতে আসেন। ভাই এবং বোনেরা, বাবা মা হওয়া অনেক বিশাল একটা দায়িত্তের ব্যাপার, শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার ভীতর তা সীমাবদ্ধ থাকেনা। বাচ্চার সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করা কোন সহজ কাজ নয়। আপনারা সেই কঠিন কাজটি করে চলেছেন, তার জন্য আপনাদের স্যালুট। এত কষ্টের পরে বাচ্চাটি যদি বড় হয়ে আপনাদের সাথে এমন ব্যাবহার না করে যেমনটি আপনি আপনার বাবা মা এর সাথে করেছেন তাহলে হয়তো আপনি বেশি কষ্ট পাবেন, কারণ আপনি হয়তো সেলফোন হাতে নিয়ে জন্মাননি যেটা আজকালের শিশুরা করছে।
Modern Problems require Modern Solutions.আর আপনি পারেন সচেতন হতে, আর সচেতনতা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। একটি অসামাজিক জাতিতে পরিনত হওয়া থেকে আমাদের পরবর্তী জেনারেশানকে রক্ষা করতে।
Iftekhar Ahmed
10 months ago