২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। রাজধানী ঢাকার পিলখানাতে অবস্থিত বিডিআর হেডকোয়ার্টারে বার্ষিক বিডিআর সপ্তাহের শুরু, উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যথারীতি, তিনদিন ব্যাপি অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন ২৫শে ফেব্রুয়ারী, পিলখানায় অবস্থিত দরবার হলে উপস্থিত হন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। বছরের এই একটা সময়েই সাধারণ সৈনিকেরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সান্নিধ্য পেয়ে থাকে। দাবি দাওয়া উত্থাপনের সুযোগও পাওয়া যায় এই সময়ে। সকাল ৯টা বেজে ২৬মিনিট, দরবার হলের সেই সভাতেই বিডিআর সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসে। অস্ত্রের মুখে প্রথমে জিম্মি করা হয় বিডিআর প্রধানসহ উচ্চ পদস্থ কিছু অফিসারকে। দরবার হলে আটকে পড়া অবস্থায় বিডিআর প্রধান জেনারেল শাকিল একে একে ফোন করেন, প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, র্যাব প্রধান ও ডিজিএফআই প্রধানকে। বিডিআর সৈন্যদের বিদ্রোহের ব্যাপারে জানিয়ে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন।
তারপর কি হলো? কোন দিকে আগালো ঘটনা? কেন আগালো? সার্চ অব মিস্ট্রির আজকের পর্বে জানাবো বিডিআর বিদ্রোহের পুরো রহস্য। গত ১৫ বছরে এই বিদ্রোহ নিয়ে কেন কথা বলা যায়নি। আজ জানাব সবকিছু। প্রিয় দর্শক, সঙ্গত কারণেই আজকের ভিডিওটি ধৈর্য ধরে দেখতে হবে।
বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। ১০ টা ১০ এর দিকে র্যাবের একটা দল বিডিআর ৩, ৪ ও ৫ নাম্বার গেটে মোতায়েন করা হয়, এর ঘন্টাখানেক পরেই সেনাবাহিনীর একটি অগ্রগামী দল পৌঁছায় পিলখানায়। বিদ্রোহের খবর শোনার সাথে সাথেই ডিএমপি পুলিশ কমিশনার রমনা জোনের ডিসি এবং লালবাগ থানার ওসিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে অবস্থান নিতে আদেশ করেন। কিন্তু এত আয়োজনের পরেও কোন এক অদৃশ্য কারণে সেনাবাহিনী, র্যাব বা পুলিশ কেউই একশনে যায়নি।
অথচ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হলে বেঁচে যেতে পারতো ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারের প্রাণ। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সেদিন সেনাবাহিনীর অত্যন্ত চৌকস কিছু অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিলো। ভেতরের খবর বলছে, সেদিন কিছু অফিসারদের ট্র্যাক করে এক রকম টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছিলো।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন সংগঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমন বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ?
বিদ্রোহীদের তথাকথিত অভিযোগ এবং দাবিদাওয়াগুলোই বা কি ছিলো? নাকি এর পিছনে লুকায়িত আছে কোন অজানা রহস্য?
কোন বৈদেশিক শক্তি কি এর কলকাঠি নেড়েছিলো? এই ঘটনায় কারা লাভবান হয়েছিলো? এবং জঘন্য এই ঘটনার সুদুরপ্রসারী কোন প্রভাব আছে কি না?
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করলে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কিছু কারণ পাওয়া যায়।
প্রত্যক্ষ কারণ
ঠিক কি কারণে বিডিআর সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিলো, তা ঘটনার সময়েই সাংবাদিকদের কাছে বিদ্রোহী সৈন্যরা বলেছিলো। তাদের দাবি-দাওয়াগুলো তুলে ধরেছিলো। সেসব বিষয়কে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে তুলে ধরা যায়।
১। ১৯৯১ এর বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের শাস্তি না দেওয়া
১৯৯১ সালের বিদ্রোহে কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বিদ্রোহ করে পার পেয়ে যাবার এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিলো।
২। অপারেশন ডাল ভাত
আরেকটি কারণ অপারেশন ডালভাত। সে সময়ের উচ্চমূল্যের বাজারে বিডিআরের তত্ত্বাবধানে স্বল্প মূল্যে জনসাধারণের নিকট নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিত। সে সময় অপারেশন ডালভাত সারাদেশ ব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলো। কিন্তু এই কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিডিআর সদস্যদের উপর অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক বিডিআর সদস্যকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এই পদক্ষেপ সৈনিকদের মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি করে এবং ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সেই ক্ষোভের উদগীরণ ঘটে।
৩। আর্মিদের সাথে বৈষম্য
আরেকটি বড় কারণ ছিলো, আর্মি সদস্যদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিডিআর শিবিরের অসন্তোষ।সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেনাসদস্য ও বিডিআর সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য ছিলো চোখে পড়ার মত। যে বিষয়গুলোতে বিডিআর জওয়ানরা নিজেদের বৈষম্যের স্বীকার বলে মনে করতো
পরোক্ষ কারণ
১। গোয়েন্দা ব্যর্থতা
আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ কারণগুলো বিদ্রোহের আগুন জ্বালালেও কতগুলো পরোক্ষ কারণ বিদ্রোহের পটভূমি রচনা করে দিয়েছিলো। এর মধ্যে একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা বা নিষ্ক্রিয়তা। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পূর্ব থেকেই বিদ্রোহে অংশ নেয়া কিছু বিডিআর সদস্য দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত কিছু বেসামরিক ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাত করে আসছিলো।
আনিসুজ্জামান খানের বেসামরিক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সে সকল রাজনীতিবিদেরা ছিলেন, শেখ ফজলে কবির তাপস, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শেখ সেলিম প্রমূখ। বিদ্রোহের এত পূর্ব থেকে বিদ্রোহীরা কার সাথে, কি কারণে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলো তার সম্পর্কে হয় পুরোপুরি বেখবর ছিলো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো অথবা জেনেও চুপ ছিলো।
দ্বিতীয়ত, বিডিআর ডিটেকটিভ এজেন্সির সদস্যরাও বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলো কিন্তু এজেন্সি কোন এক অজানা কারণে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলো না।
চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রার বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্ট অনুযায়ী, সাবেক সেনা অফিসার ড. খান মোহাম্মদ সুবায়েল বিন রফিক বলেছেন, “ঘটনার পরিকল্পনা হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে। এরপর তিন মাস ধরে বিডিআরের ৫০ জনের মতো সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বেসামরিক ব্যক্তির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এসব তথ্য জানতে পারেনি এটা সম্পূর্ণ অসত্য। জেনেও তারা গোপন করেছিল।“)
২। নিষ্ক্রিয় বিজিবি গঠন
বিডিআর ভেঙে গঠিত হওয়া বিজিবি গত ১৫ বছরে অসংখ্য সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে কেবল পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ ছিলো, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের আটক করেও ফিরিয়ে দিতে হতো বিএসএফের হাতে। সরকারি হিসেব মতে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সীমান্তে ২৯১ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে বিএসএফ, এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ এ হত্যা করা হয় আরও দুই শতাধিক মানুষকে। অথচ দাবি করা হয়ে থাকে এসময়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অন্য যে কোন সময়ের থেকে অনেক ভালো।
৩। সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করার চেষ্টা
পিলখানার সেই ঘটনার পর সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এবং ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এবং ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সরকারদলীয় অথবা সরকারের প্রতি বিশেষভাবে অনুগতশীল লোকদের পদায়ন করা হয় এবং অবারিত দূর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হয়, তৈরি হয় জেনারেল আজিজ ও জিয়ার মত লোক। ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনীর সরকার বিরোধী হয়ে ওঠা এবং সেনা অভ্যুত্থান ঘটাবার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে যে প্রশ্নটা ঘুরেফিরে চলে আসে সেটি হচ্ছে, এই স্বরযন্ত্র কী দেশ থেকেই করা হয়েছে নাকী বিদেশ থেকে?
৪। দেশীয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র
২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১২.৩০ এর দিকে বিডিআর ৩নং গেইটে শতাধিক মানুষ মিছিল নিয়ে যায়, এবং তারা বিডিআরদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। এ সময় তাদেরকে “জয় বাংলা, জয় বিডিআর” “বিডিআর-জনতা ভাই ভাই” প্রভৃতি স্লোগান দিতে শোনা যায়। এই লোকগুলো কারা, কি কারণে তারা আসলো এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের স্লোগান “জয় বাংলা” স্লোগানই বা কেনো দিলো, কার নেতৃত্বে তারা জড়ো হয়েছিলো সেসব কিছুই সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা হয়নি।
আনিসুজ্জামান খানের তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে কয়েকজন আওয়ামীলীগের রাজনীতিবিদের নাম উঠে এসেছে যাদের সাথে বিদ্রোহে অংশ নেয়া বিডিআর সৈন্যরা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার সাক্ষাত করেছিলো। তারা হচ্ছেন সেসময়ের আওয়ামিলীগের এমপি শেখ ফজলে নুর তাপস, শেখ সেলিম, মির্জা আজম প্রমুখ।
এবং ২৬ তারিখ তাপসের নির্দেশে পিলখানার চারদিকের তিন কিলোমিটার এলাকা থেকে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়। পুলিশ, র্যাব ও আর্মি সরে যাবার পর খুব সহজেই হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়া সৈন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। রিপোর্টে সেই ঘটনা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
“It was found that the area was not cordoned giving an excuse of the geographical position (dense population, tannery, etc) of Peelkhana not being suitable for carrying out a raid by Police and RAB, which is not logical.As a result, rebels could easily run away by climbing the walls.
According to witnesses, many BDR members and their family and relatives were able to go out easily through gates 1 and 5 with help from their well wishers.”
এই মন্তব্য থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে বিদ্রোহীদের পালিয়ে যেতে কেউ সহযোগিতা করেছিলো।
উল্লেখযোগ্য আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পনের পর, তাদের কোন পরিবারের সদস্যদের পিলখানার বাইরে আসতে দেখা যায়নি অথচ শতশত জেসিও এবং সৈনিকরা তাদের পরিবারের সাথে সেখানকার কোয়ার্টারে থাকতো। সুতরাং এইটা সুস্পষ্ট যে তাদের ইতিমধ্যেই পিলখানা ত্যাগের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এটাও ধারণা করা যায়, অধিকাংশ বিডিআর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা বিদ্রোহ শুরুর পূর্বেই পিলখানা ত্যাগ করেছে।
আনিসুজ্জামানের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অফিসারদের প্রতি সাধারণ সৈন্যদের ক্ষোভ ছিলো, কিন্তু কেবলমাত্র সে ক্ষোভ এমন নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। সেই রিপোর্টে বলা হয় যে বিডিআর বিদ্রোহ গভীরভাবে পরিকল্পনা করে ঘটানো একটা ঘটনা যার পরিকল্পনা চলছিলো প্রায় ২ মাস ধরে।
সামরিক ও বেসামরিক উভয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট, সম্প্রতি টিভি চ্যানেলে সাবেক সেনা অফিসার ও নিহত সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তৎকালীন আওয়ামিলীগ সরকারকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়।
৫। বিদ্রোহ পরবর্তী তদন্তে বাঁধা
নেপথ্যে কারা ছিলো খুঁজে বের করা গেছে কি? নাকি আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ধরে সত্য গোপন করতে চেয়েছে?
বিস্তারিত তদন্ত শেষেও সাবেক সচিব আনিসুজ্জামান খানের তদন্ত কমিটি, ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিলো এ প্রশ্নে উত্তর দিতে পারেনি। কেন পারেননি তার একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, ডিজিএফআই, এনএসআই প্রভৃতি ইনটেলিজেন্স এজেন্সির অসহযোগিতা। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে সরকারি সংস্থা অসহযোগিতা করবে সেইটা অবিশ্বাস্য বেপার যদিনা সরকারের বিধিনিষেধ না থাকে!
বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে কারা ছিল?
দুটো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট, পূর্ববর্তী কিছু ঘটনা, বিডিআর বিদ্রোহের ফলাফল এবং পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি এইসবগুলো ডট যদি কানেক্ট করা যায় তবে একটা সম্ভাব্য উত্তর মিলে যাবে।
তার পূর্বে আমাদের জানতে হবে, এই ঘটনার বেনিফিশিয়ারি কারা?
বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে কারা ছিল?
১। বিএসএফের নির্মম পরাজয় - India’s Revenge
২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কোন প্রকার কারণ ছাড়াই অতর্কিত ভাবে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। ১০৬৭/৩ পিলার অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী বিডিআর ক্যাম্পের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে এবং বিডিআর ক্যাম্প লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ঘটনার দিন ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বড়াইবাড়ী বিওপিতে ডিউটিতে ছিলেন মাত্র ১১ জন বিডিআর সদস্য। তারাই প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে এবং পরবর্তীতে আশেপাশের বিডিআর ক্যাম্প থেকে আরও জওয়ান ও গ্রামবাসি তাদের সাথে যোগ দেয়।
সে যুদ্ধে ভারতের বিএসএফের একজন অফিসারসহ ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় ও বিডিআরের ৩ জন জওয়ান শহিদ হয়। ধারণা করা হয় বিএসএফের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। ঘটনাটি পুরো ভারত জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং এই ঘটনার পর ভারতের ডিফেন্স মিনিষ্টার জসবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান দেন এ ঘটনার বদলা নেয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই যুদ্ধের প্রতিশোধ কি নেয়া হয়েছিলো ভারতের পক্ষ থেকে?
ভারতীয় সিমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ একটি সিভিল ফোর্স, অন্য দিকে তৎকালীন বিডিআর ছিলো সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষিত এবং সেনা কমান্ডে পরিচালিত একটা আধাসামরিক বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে বিডিআরের সক্ষমতা সেনাবাহিনীর মতই ছিলো। যার ফলে বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে সক্ষমতার দিক থেকে এক ধরনের ব্যবধান ছিলো। আর সে কারণেই যতবার বিডিআর এবং বিএসএফ মুখোমুখি হয়েছিলো, বিএসএফকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিলো। সুতরাং আর্মি কমান্ডে পরিচালিত বিডিআরের চোখে চোখ রেখে কথা বলা, এবং ইটের জবাবে পাটকেল মারবার বিষয়টি ভারতের মত বৃহৎ শক্তির দেশের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিলো। এবং বড়াইনবাড়ীর যুদ্ধ ছিলো ভারত সরকারের গালে চপেটাঘাত। তাই বিডিআর নিয়ে ভারত সরকারের ক্ষোভের কারণ সুস্পষ্ট ছিলো। ভারত সরকার কখনোই চায়নি, বিডিআরের কমান্ড সেনা অফিসারের হাতে থাকুক। ভারতের এই আকাঙ্খার সাথে বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের আকাঙ্খা মিলে যায়।
বাংলাদেশে বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২১ মাস পর, বিএসএফ তথা ভারতকে পরাজিত করা বিডিআর বাহিনীই বিলুপ্ত করা হয়। অথচ এ বিডিআর বাহিনীর ছিলো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের দুজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন ইপিআর তথা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের।স্বাধীনতার পর যার পরিবর্তিত নাম হয় বিডিআর।
অতএব যেভাবেই হোক ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে, ২০০১ সালে বড়াই বাড়ির যুদ্ধে নিহত বিএসএফ সদস্যদের প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যায়।
অতএব বিডিআর বিদ্রোহ ও জওয়ানদের বিডিআর থেকে সেনাবাহিনী হঠানোর দাবি মোটেও কাকতালীয় নয়, বরং সুপরিকল্পিত।
২। সেনাবাহিনীকে স্বৈরাচারের পুতুলে পরিণত করা
২. বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয় এবং একসাথে এতগুলো চৌকস অফিসার হারিয়ে সেনাবাহিনী অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেনাবাহিনীর দুর্বলতা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের জন্য শাপে-বর হয়ে দেখা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খুবই সিগনিফিকেন্ট। যখনই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়েছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে তৎপর হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের পর সরকারের হাতে সুবর্ণ সুযোগ আসে সেনাবাহিনীকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেবার। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের অনুগত লোক বসিয়ে এবং তাদেরকে অপার অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকার সে সুযোগ খুব চতুরতার সাথে কাজে লাগিয়েছে। এরই ফলাফলে আমরা তিনটি বিনা ভোটের, সাজানো এবং প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচন দেখেছি।
৩। রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং RAW
৩. সময় ১৯৪২ সাল! গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ছাড় আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনে অংশ নেবার দরুণ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গ্রেফতার করা হলো অসংখ্য কংগ্রেস নেতা-কর্মীকে। আহমদনগর ফোর্টে কারাবাস দেওয়া হলো তাদের। এদের মধ্যে নেহেরু ছিলেন অন্যতম। জেলে বসেই তিনি রচনা করলেন ‘The Discovery Of India.’ এই গ্রন্থের শেষের দিকে নেহেরু ভারতের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনা করেছিলেন। যা ছিল মূলত ‘অখন্ড ভারত তত্ত্ব’, যে তত্ত্ব পরবর্তীতে Neheru Doctrine Or India Doctrine নামে পরিচিত লাভ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর নেহেরু তাঁর এই মতবাদ একটি ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন। যে তত্ত্বের মূলকথা —
অবশ্যম্ভাবীভাবে ভারত তার আধিপত্য বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তারা স্বাধীন থাকবে না। নেহেরু পররাষ্ট্রনীতির এই মডেল গ্রহণ করেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্র হতে। যার মূল কথা, রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিবেশি রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে হবে। কিন্তু ভারত চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে তার চারদিকের রাষ্ট্রগুলোকে পাপেট রাষ্ট্র বানানোর মিশন গ্রহণ করে। আর এই মিশন পুরনের জন্যই গঠিত হয়েছি, ‘Research and Analysis Wing’ সংক্ষেপে ‘RAW’।
২০১৩ সালের কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের পর, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একের পর এক অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিবেশির সকল স্বার্থ রক্ষা করেও বিনিময়ে কিছুই পায়নি বাংলাদেশ।
৪। ভারতের ক্রমাগত স্বার্থসিদ্ধি
২০১৯ সালে বাংলাদেশ-ভারতের এই অসম সম্পর্ক নিয়ে করা একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে শহিদ হতে হয় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের বুক চিড়ে ভারতকে দেয়া হয় রেল ট্রানজিট, মংলা সমুদ্র বন্দরের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় ভারতের হাতে, বিনিময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে আসেন কেবল আশ্বাস।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশকে ভ্যাসেল স্টেট বানানোর সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার বড় প্রমাণ হাসিনার পতনের সাথে সাথে হাসিনাকে আশ্রয়দান সহ ভারতের পক্ষ থেকে নেয়া নানান পদক্ষেপ এবং সর্বশেষ নজিরবিহীন বন্যা।
যদি বিডিআর বিদ্রোহ না ঘটতো, যদি সেদিন ৫৭ জন সেনা অফিসারকে মেরে ফেলা না হতো তবে, সেনাবাহিনী হাসিনার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা ছিলো।
অতএব এটা সন্দেহাতীত যে বিডিআর বিদ্রোহের দেশীয় সুবিধাভোগী শেখ হাসিনা এবং আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগী ভারত।
আগে পরে সব ঘটনা, তদন্ত রিপোর্ট, তথ্য-প্রমাণ ও ভারত-হাসিনা জুটির সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি হাসিনা ও হাসিনাকে আশ্রয়দাতা দক্ষিণ এশিয়ার নয়া-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতকেই বিদ্রোহের নেপথ্যের শক্তি হিসেবে ইঙ্গিত করে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সুযোগ এসেছে বিডিআর বিদ্রোয়ের আসল সত্য খুঁজে বের করার। দেড়ি হয়ে গেছে যদিও, কিন্তু সুযোগ এখনও আছে। বিডিআর বিদ্রোহ নিছক একটি ঘটনা নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব গ্রাস করে নেয়ার ভারতীয় নীল নকশা লুকিয়ে আছে এই ঘটনার গভীরে। দেশের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সেই গভীর ও গোপন সত্যকে প্রকাশ করতে জাতির সামনে, পুরো দুনিয়ার সামনে।
Script Affiliate:
মো: মামুনুর রশিদ
মুনিম রাব্বি